টেলিভিশনে সংবাদ প্রযোজনা ও প্রযোজকের দায়িত্ব পর্ব– ০২
প্রযোজকের দায়িত্ব
সংবাদ প্রযোজকরা অত্যন্ত সংগঠিত এবং ছোট থেকে বড় প্রতিটি বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তারা চাপের মধ্যে ভালো করেন এবং সংবাদ সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখেন। প্রযোজক সাধারনত সংবাদ লেখায় অসাধারন হবেন, বিশেষ করে চাপের মুখে এবং তাৎক্ষনিকভাবে খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে প্রতিবেদন তৈরি করতে সক্ষম হবেন।
সংবাদ প্রযোজক দায়িত্ব অনেকদূর বিস্তৃত, এবং এর কোনটিই অন্যটির চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন:
- প্রযোজক উপস্থাপকের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখে দেন, যদিও কোখাও কোখাও একাজটি উপস্থাপক নিজেই এ কাজটি করে থাকেন।
• নিউজ শো সম্পূর্ণ গুছানোর কাজটি করে থাকেন, যাতে পর পর সংবাদগুলি সঠিক অবস্থানে ঠিক থাকে।
• সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের শিরোনাম গুলো ঠিক করে নেন।
• নতুন কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে কিনা তার জন্য প্রযোজক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার দেয়া সংবাদগুলো লক্ষ্য রাখেন।
• প্রতিবেদনের ভিডিও সম্পাদনা ঠিক করে দেন।
• সংবাদের সময় নিয়ন্ত্রণ করেন যাতে তা সঠিক সময়ে শুরু এবং শেষ করা যায়; প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন বিরতি ঠিক করেন।
• উপস্থাপক,স্টুডিও ক্রু এবং ক্যামেরা পারসনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং নির্দেশনা দেন।
• যখন কোন ঘটনা ঘটতে থাকে তখন আউটডোরে থাকা রিপোর্টার এবং ক্রু-দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
• নিউজ শো-এর আগে পরে নানা টিজার, হেডলাইন লিখেন ও তৈরির নির্দেশনা দেন।
• সরাসরি সম্প্রচারে থাকা প্রযোজক ও রিপোর্টারের সাথে কাজের সমন্বয় করে থাকেন।
উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারছি আদর্শগতভাবে বা বলা যায় বিশ্বজুড়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে একজন সংবাদ প্রযোজক কিভাবে কাজ করেন বা সংবাদ প্রযোজকের কাজ কি। বলে রাখা ভালো আমাদের দেশের কোন চ্যানেলই এই কর্ম পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করা হয় না। এর রয়েছে নানা কারন এবং ইতিহাস যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
এবার আসা যাক সংবাদ প্রযোজনা বিভাগের কাজে। পূর্বে যদিও প্রযোজকদের কাজ সম্পর্কে একটি আদর্শ ধারনা দেয়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবেও অনুসৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে প্রযোজনা বিভাগের কর্মীরা মূলত সংবাদের কারিগরি দিক বিশেষত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনা, এবং অডিও-ভিডিও সম্পাদনার মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকে। অবশ্য অভিজ্ঞতার বিচারে সিনিয়র প্রযোজকরা সংবাদের স্ক্রিপ্টসহ নানা বিষয়ে নিজেদের মতামত দিয়ে থাকেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তও নেন।
টেলিভিশনে প্রযোজকদের কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে সংবাদ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বা PCR (Presentation/Production Control Room)। মূলত স্টুডিওতে ক্যামেরার মাধ্যমে উপস্থাপক এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সংবাদে ভিডিও প্রতিবেদন সংযোজনে নির্দেশনা, সংবাদে প্রতিবেদন সমূহের ক্রম ঠিক রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কর্মরত অন্যান্য কর্মীদের তাৎক্ষনিক নির্দেশনা প্রদান এসবই হচ্ছে সংবাদ প্রযোজকের কাজ। আর এই কাজগুলো করার পূর্বেই প্রযোজক বার্তাকক্ষে থেকে পুরো সংবাদ বুলেটিনের প্রতিবেদন ও অন্যান্য অলংকারিক বিষয়গুলী গুছিয়ে নেন, সম্ভাব্য সবক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট দেখে কোন ভুল মনে হলে সংশোধন করার জন্য বার্তা সম্পাদক বা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেন বা কাজটি করিয়ে নেন।
প্রডাকশন দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটি নব্বই’র দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে (মূলত বিটিভি) সংবাদ সম্প্রচারের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
• কারিগরি সিমাবদ্ধতার কারনে সংবাদে শুধু উপস্থাপক এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের ছবিই শুধু দেখানো সম্ভব হত।
• প্রথমদিকে রিপোর্টারের ভাষায় তার রিপোর্ট বর্ণনা করা সম্ভব হত না।
• সংবাদ পুরোটাই উপস্থাপকের মাধ্যমে পাঠ করা হতো এবং তার কথার সাথে কিছু কিছু ছবি দেয়া সম্ভব হত।
• তখন স্টুডিও’র বাইরে বা আউটডোরে দৃশ্যধারন অনেক ব্যয়বহুল এবং ঝামেলাপূর্ণ ছিল, তাই সংবাদ থাকলেও অনেক সময়ই ছবি থাকতো না।
• সংবাদে গ্রাফিক্সের ব্যবহারও ছিল না বললেই চলে।
• উপস্থাপককে প্রায় পুরো সংবাদ চলাকালীন একটি ক্যামেরায় একই ফ্রেমে রাখা হতো।
• লাইভ বা সরাসরি কোন স্থান থেকে সম্প্রচার বা রিপোর্টারের মাধ্যমে ঘটনার কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল। এখন যা হরহামেশাই বিভিন্ন চ্যানেলে হতে দেখা যায়।
বর্তমান সময়ে এসে সংবাদ পরিবেশনায় এসেছে অনেক বৈচিত্র, আছে চ্যালেঞ্জ, শুধুমাত্র উপস্থাপকের পারফরম্যান্সের উপর নয় বরং সংবাদের ক্রমে, তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে দর্শকের সংযোগ স্থাপন এবং পরিবেশনায় নানামুখী নিত্য নতুন চিত্তাকর্ষক বিষয়াদি যুক্ত করে সংবাদ হয়ে উঠেছে এক উপভোগ্য আয়োজনে। ফলে দর্শক এখন অনেক বেশি সংবাদমুখী হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সংবাদ প্রযোজকদের সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হতে হয় চৌকষ। দিনের ঘটনার প্রতি প্রযোজকের থাকতে হবে তীক্ষ্ণ মনযোগ। সময়ের প্রেক্ষিতে টেলিভিশনের পর্দায় যেসব ছবি দেখা যায় তাতে যেমন এসেছে নানা বৈচিত্র্য, তেমনি কোন দৃশ্য বা ছবি সব ধরনের দর্শকের জন্য নয়, কোন বিষয় টিভি পর্দায় প্রদর্শন যোগ্য আর কোনটি যোগ্য নয়, কোনটি শিশুদের জন্য নয়, এসব নানা বিষয়ে এসেছে বাধ্যবাধকতা, এথিকস্ ইত্যাদি নানা বিষয়। টেলিভিশনের একজন প্রযোজকের সাধারনভাবে যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয় তার সাথে এখন এসব বিষয়ও যুক্ত হয়েছে। ফলে কাজের প্রয়োজনে প্রযোজককে হয়ে হয় একজন পরিচালক, একজন সম্পাদক এবং সর্বোপরি একজন সাংবাদিক।
পাশাপাশি এখন সময়টাই এমন যে, সংবাদ আর পরের দিনের প্রত্রিকার পাতার বিষয় নয়, এখন সময় তাৎক্ষনিক সংবাদের, মানুষ এখন ঘটনার সময়ই জানতে চায় কি ঘটছে। তাই সংবাদে লাইভ বা সরাসরি ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ পরিবেশন হয়ে উঠেছে একটি অত্যাবশ্যকীয় এবং চ্যালেঞ্জিং। এমনও দেখা যায়, এখন প্রতিটি সংবাদ বুলেটিনে পরপর একাধিক বা পাঁচ-ছয়টিও লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার থাকে। এতে অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তির অবদান অনস্বিকার্য। একটি সংবাদ বুলেটিনে পরপর বেশ কয়টি লাইভ ইভেন্ট করতে প্রযোজকদের প্রয়োজন হয় বিশেষ দক্ষতার। একজন বুলেটিন প্রযোজকের আদর্শ দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। এবার দেখে নেই সময়ের প্রেক্ষিতে এখন একজন প্রযোজককে আরও কোন কোন বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হয়।
• প্রযোজক বুলেটিনের পূর্বেই জেনে নিবেন কোথায় কি ঘটছে, এবং সংবাদের কোন অবস্থানে লাইভ ইভেন্ট অন এয়ারে যাবে।
• সাথে সাথে প্রস্তুতি নিতে হবে এর সাথে প্রয়োজনীয় গ্রাফিক্স, পূর্বের রেফারেন্স ছবি থাকলে তা প্রস্তুত রাখা পাশাপাশি পরিবেশনের জন্য।
• প্রযোজককে আরেকটি বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিতে হয়, তা হচ্ছে যোগাযোগ। এই যোগাযোগ স্বতস্ফুর্ত এবং আন্তরিক হতে হবে ঘটনাস্থলে অবস্থানরত রিপোর্টার, ক্যামেরা পারসন, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে নিজের সহকারী প্রযোজক, বার্তা সম্পাদক, এ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক, উপস্থাপক এবং সবশেষে কন্ট্রোলরুমে যারা বুলিটিন পরিচালনায় কাজ করছে এমন প্রতিটি ব্যাক্তির সাথে।
• বুলেটিন শুরুর আগেই সবাইকে প্রযোজক কি করতে চাইছেন, কিভাবে করবেন, কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ইত্যাদি বিষয় ভালোভাবে এবং সহজে ব্যাখ্যা করে দিবেন।
• সংবাদ পরিচালনাকালীন প্রযোজককে থাকতে হবে শান্ত, প্রতিটি কমান্ড দিবেন পরিষ্কারভাবে এবং উচ্চস্বরে যাতে কন্ট্রোলরুমের সকলে তা পরিষ্কারভাবে শুনতে পায়।
• বলার অপেক্ষা রাখে না স্টুডিও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়, যেমন- ক্যামেরা, লাইট, কন্ট্রোলরুমের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কার কি দায়িত্ব এসব বিষয়ে প্রযোজকের থাকতে হবে স্বচ্ছ ধারনা, তবেই তিনি সফলভাবে সবকিছু পরিচালনা করতে পারবেন।
• সর্বোপরি একজন প্রযোজক হবেন একটি টিভি স্টেশনের প্রতিটি বিভাগের কাজের সাথে সমন্বয়কারী একজন ব্যাক্তি এবং থাকতে হবে সবার সাথে সুসম্পর্ক।
টেলিভিশনে ভাল মানের প্রডাকশন দিতে হলে, যাকে বলে সংবাদ বুলেটিন বা অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে হলে তার প্রযোজকদের মানের উন্নয়নের কোন বিকল্প নাই। আর এটি করতে হলে ব্যাক্তি পর্যায়ে যারা প্রযোজক হিসেবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের অবশ্যই নিজের কাজের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, যা পূর্বেই আলোচনা করেছি। পাশাপাশি টেলিভিশন স্টেশনগুলোর উচ্চ পর্যায়ের বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। প্রযোজকের মান উন্নয়ন যেখানে টিভি পর্দার কাজের মান বৃদ্ধি করবে সেখানে তাদের মান উন্নয়নে কর্তৃপক্ষও নিতে পারে নানা পদক্ষেপ। সময় সময় বিভিন্ন ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, দেশের বাইরের অভিজ্ঞ প্রযোজকদের সাথে মত বিনিময় বা ওয়ার্কশপ, প্রয়োজনে দেশের বাইরে নিয়ে উন্নত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা, এসবই কর্তৃপক্ষ করতে পারে।
টেলিভিশন প্রযোজক, বাংলাদেশে এই পেশা যেমন নতুন, তেমনি আশার কথা এই যে এদেশের প্রযোজকরা তাদের কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আধুনিক সময় এবং প্রযু্ক্তির নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে যেভাবে তাদের কাজ করে যাচ্ছে, তা কোন অংশেই খাটো করে দেখার নয়। আধুনিক বিশ্বের প্রযোজকদের কাজের ধরন এবং ধারনার সাথে আরও পরিচয় ঘটলে তারা গুনে মানে আরও ভালো কাজ করতে পারবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
ইকবাল আহমেদ খোকন