টেলিভিশনে সংবাদ প্রযোজনা ও প্রযোজকের দায়িত্ব পর্ব– ০১
প্রযোজনা বিভাগ, টেলিভিশনে যা প্রডাকশন বিভাগ নামেই পরিচিত।
প্রডাকশন কথাটা শুনলেই সবার মানসপটে যে ছবি ফুটে ওঠে তা মূলত কোন শিল্প-কারখানায় পণ্য উৎপাদন-কে বূঝায়। “প্রডাকশন” ভালো বলতে উৎপাদনের মান ও পরিমান ভাল এই-ই আমরা বুঝি। কিন্তু প্রাথমিকভাবে টেলিভিশনে প্রডাকশন বলতে তা হলে আমরা কি বুঝবো ?
মজার বিষয় হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি বলতে যে শিল্প বুঝায় সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে টেলিভিশন একটি ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া আর কিছুই নয়। এখানেও রয়েছে পণ্য উৎপাদন, বিপণণ বা বাজারজাত করণের মতো বাণিজ্যিক সব কর্মকান্ড। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তাই এ বিষয়গুলো সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দিতে চাই। টেলিভিশনে পণ্য হচ্ছে তার অনুষ্ঠান, সংবাদ কিংবা হালে টিভি’র পর্দা জুড়ে থাকা নানা ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল বা টিভি পর্দার স্হান, সময় ইত্যাদিকেই বুঝায়। টেলিভিশনের বিপনণ বা মার্কেটিং বিভাগের কর্মীরা এই অনুষ্ঠান, সংবাদ বা অন্যান্য বিজ্ঞাপন প্রচার উপযোগী বিষয় গুলোকে স্পন্সর বা যারা বিজ্ঞাপন দেন এমন বাণিজ্যিক বা প্রতিষ্ঠান সমূহের কাছে নিয়ে যান এবং বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেন। মূলত সাদা কথায় এটাই হচ্ছে টেলিভিশনের পণ্য কেনা-বেচার প্রক্রিয়া।
এতো গেল বিপনণ বা মার্কেটিং-এর কাজ। পাশাপাশি বাজারজাত করণ হচ্ছে তাই-ই যা আমরা টিভি’র পর্দায় দেখি এবং ঘরে ঘরে টিভি’র পর্দা পর্যন্ত নিজ নিজ চ্যানেলকে পৌঁছে দিতে কাজ করে টেলিভিশনের ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের কর্মীরা। এরা মূলত ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কের সাথে মিলে এ কাজটি করে থাকে। আমাদের আলোচনায় আমরা সে বিষয়ের গভীরে আর যাব না, তা না হলে আলোচনার কলেবর বেড়ে যাবে এবং অপ্রসঙ্গিকও হবে।
টেলিভিশন সংবাদ বিভাগে মূলত কাজ করে রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক অর্থাৎ যারা সংবাদ সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি এবং তা সম্পাদনা করে সম্প্রচার উপযোগী করার কাজটি সরাসরি করে থাকেন। এরাই মূলত সাংবাদিক। সংবাদ বিভাগেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপ-বিভাগ হচ্ছে ‘প্রডাকশন’।
এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে, অর্থাৎ প্রডাকশন বা উৎপাদন বিভাগের আলোচনায়। উৎপাদন বলতে পণ্য অর্থাৎ টেলিভিশনের ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান, সংবাদ ইত্যাদিকেই বুঝায়, তা আমরা আগেই জেনেছি। শিল্প-কারখানার মতোই এখানেও রয়েছে এক ঝাঁক কর্মী যারা এই উৎপাদন অর্থাৎ সংবাদ বা অনুষ্ঠান তৈরি প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে আছেন। এখানেও অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থার মতো দু’টি ভাগ আছে, একটি হচ্ছে কাঁচামাল সরবরাহ আর অন্যটি ফাইনাল প্রডাকশন বা পণ্য উৎপাদন। এক্ষেত্রে ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিই হচ্ছে প্রাথমিক কাঁচামাল এবং তা থেকে বিভিন্ন প্রাক্রিয়া ও অনুবিভাগ হয়ে তৈরি হয় পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান বা সংবাদ, অর্থাৎ পণ্য।
বিভিন্ন সাংবাদিক বা রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যান মিলে দৃশ্য ধারণ এবং প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার, অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রায় একইভাবে দৃশ্য বা সংলাপ যাই বলি না কেন, তা নিয়ে এডিট বা সম্পাদনা (ভিডিও এবং স্ক্রিপ্ট) –এর মাধ্যমে তৈরি করেন বিভিন্ন রিপোর্ট বা স্টোরী। তারপর সব রিপোর্ট বা স্টোরী এক করে দিয়েই তৈরি হয় পূর্ণাঙ্গ সংবাদ বা অনুষ্ঠান। সংবাদ বা অনুষ্ঠান তৈরির এই কর্ম প্রক্রিয়ার পরিবেশনা এবং সঞ্চালনের ভাগে জড়িয়ে আছেন টেলিভিশনের প্রডাকশন বিভাগের কর্মীরা, যারা প্রডিউসার বা প্রযোজক হিসেবে পরিচিত।
টেলিভিশনের কর্ম প্রক্রিয়াটিই এমন যে, এখানে কেউ এককভাবে বা কোন বিভাগ এককভাবে কোন অনুষ্ঠান বা সংবাদ তৈরি করতে পারেন না, সবাই মিলে দলগতভাবে তৈরি হয় টেলিভিশনের প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ সংবাদ বা অনুষ্ঠান। কাজের ধরন অনুযায়ী প্রডাকশন বিভাগ বা প্রযোজকদের কাজকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. প্রডাকশন (মূলত অনুষ্ঠান বা কোন রিপোর্ট/স্টোরী নির্মাণ, যা প্রযোজক বা রিপোর্টারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে), দুই. প্রডাকশন অপারেশন (মূলত সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান বা সংবাদ পরিচালনা বা প্রযোজনার কাজ)।
টেলিভিশনের দুটি পণ্য অনুষ্ঠান এবং সংবাদ, এই দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করলে উপরের বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝা যাবে।
টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাণ, এই প্রক্রিয়াটি মূলত ক্ল্যাসিক। নিত্য নতুন ধারনা বা কনসেপ্ট-এর পরিবর্তন ছাড়া অনুষ্ঠান নির্মাণ প্রক্রিয়া সেই শুরু থেকেই একই থেকে গেছে। তবে ক্যামেরা ও ভিডিও সম্পাদনার যান্ত্রিক দিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এগিয়েছে অনেকদূর। টেলিভিশনের দর্শন যোগ্য অর্থাৎ টিভি পর্দার ছবির মান আধুনিক ডিজিটাল মাধ্যমে বেড়েছে অনেক গুণ; এটি অবশ্য টেলিভিশনের কি অনুষ্ঠান, কি সংবাদ, কি বিজ্ঞাপন সব ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। তাই একটি অনুষ্ঠান কতোটা ভালো হবে বা অন্যভাবে বললে কতোটা দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা নির্ভর করে অনুষ্ঠানটির কনসেপ্ট বা ধারনা, সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ভালো স্ক্রিপ্ট এবং সর্বোপরি অনুষ্ঠানের প্রযোজকের দক্ষতা ও রুচির উপর। যুগের চাহিদা, উন্নত প্রযু্ক্তি এসব বিষয় অনুষ্ঠান প্রযোজনায়ও এনেছে অনেক বৈচিত্র। আমরা আমাদের আলোচনা অবশ্য সংবাদ প্রযোজনাকে ভিত্তি ধরেই করবো, তাই অনুষ্ঠান প্রযোজনার বিষয়ে আলোচনা আর এগিয়ে নেব না।
সংবাদ প্রযোজনার ক্ষেত্রে বিষয়টি অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির, কলেবরটাও অনেক বড়। এখানেই মূলত প্রযোজকরা অপারেশনাল কাজে জড়িয়ে থাকেন। যুগ যুগ ধরে সময়ের বিবর্তনে টেলিভিশনে সংবাদ প্রযোজনার ধরণ, কৌশল, নতুনত্ব, উপস্থাপনা, কারিগরি সুযোগ-সুবিধা, এসব কিছুতেই এসেছে আমূল পারিবর্তন এবং এখনও নিয়ত এগুতে থাকা ও পরিবর্তনশীল এক প্রক্রিয়া সংবাদ প্রযোজনা।
আদর্শগত ভাবে একজন প্রযোজক সংবাদের মূল চালক বা ড্রাইভার বা ক্যাপ্টেন। প্রযোজক সংবাদের প্রতিটি রিপোর্ট সম্পর্কে জানবেন, স্ক্রিপ্ট দেখবেন, প্রতিবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ছবির সজ্জা বা সম্পাদনা দেখে দেন, সংশ্লিষ্ট অডিও-ভিডিও মান ঠিক রাখবেন, সংবাদ পরিবেশনের ক্রম ঠিক করবেন, উপস্থাপকের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তৈরি করেন, সর্বোপরি সরাসরি সম্প্রচারের সময় কারিগরি নির্দেশনা দেয়াও তার অন্যতম কাজ, সচরাচর তিনি একজন জেষ্ঠ্য প্রযোজক হয়ে থাকেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থাৎ সংবাদ সংগ্রহ, প্রতিবেদন তৈরি, সম্পাদনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রযোজক, সহযোগী ও সহকারী প্রযোজকরা তার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে থাকেন এবং একটি পূর্ণাঙ্গ সংবাদ বুলেটিন তৈরি করেন। ফলে কাজেরক্ষেত্রে প্রযোজকরা কখনও রিপোর্টার, কখনও বার্তা সম্পাদক বা কখনও সংবাদ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে টেকনিক্যাল বা অপারেটরের ভূমিকায় থাকেন। বহির্বিশ্বে (যেমন- বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা) একটি রিপোর্ট বা ঘটনা বা ইভেন্ট কাভার করতে মূলত একটি টিম বা দল কাজ করে। এই দলে থাকেন ঘটনার ধরন অনুযায়ী এক বা একাধিক প্রযোজক ও তার সহকারী, রিপোর্টার বা পারফরমার (যিনি ক্যামেরার সামনে থাকবেন), ক্যামেরা পারসন, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, অনেক ক্ষেত্রে ভিডিও এডিটরও এই দলে থাকেন। স্থান-কাল বা ঘটনার ধরন অনুযায়ী এই দলে শুধুমাত্র রিপোর্টার এবং ক্যামেরা পারসন বা যেকোন একজন দিয়েই ইভেন্ট কাভার করা হয়, সেক্ষেত্রে রিপোর্টারকে অবশ্যই তার স্টেশনের প্রযোজকের দিক নির্দেশনা নিয়েই কাজ করতে হয়। ইভেন্ট কাভার করার এই দলে নেতৃত্ব দেন প্রযোজক, যার থাকে রিপোর্টিং সম্পর্কে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা, তিনি অডিও-ভিডিও সহ নানান কারিগরি দিক গুলো বোঝেন। ইভেন্ট কাভার করতে গিয়ে তিনিই রিপোর্টারকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন, তার স্ক্রিপ্ট দেখে দেন, স্টোরি এঙ্গেল ঠিক করেন। প্রযোজক টিভি সেন্টারের বুলেটিন প্রডিউসার-কে সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট সম্পর্কে অবহিত করেন এবং প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দ নেন এবং রিপোর্টটি সম্পূর্ন তৈরি করা এবং তা বুলেটিন প্রযোজককে বুঝিয়ে দেয়াও তার দায়িত্ব। অপারেশনাল (স্টুডিও/প্রডাক্শন কন্ট্রোল রুম) বা রিপোর্ট/ইভেন্ট প্রযোজক উভয়ই চুড়ান্ত এবং প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে টেলিভিশন সেন্টারের সংবাদের দায়িত্বে থাকা বার্তা প্রধান বা প্রধান বার্তা সম্পাদক কিংবা প্রযোজকের উর্ধ্বতন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে থাকেন। বলা বাহুল্য প্রযোজক সংবাদের স্ক্রিপ্ট ঠিক করা বা সম্পাদনার কাজের জন্য বার্তা সম্পাদক এর উপর নির্ভর করে থাকেন। তবে চুড়ান্তভাবে তিনিই এটি সম্প্রচারের উপযোগী হয়েছে কিনা দেখে নেন।
বার্তকক্ষের কাজের ক্রমানুসারে সংবাদ প্রযোজক নির্বাহী প্রযোজকের অধিনে কাজ করেন, তিনি বার্তা পরিচালককে তার কাজের জন্য জবাদিহি করেন। তবে এই ধারাবাহিকতা বিভিন্ন চ্যানেল থেকে চ্যানেলে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে একটি নির্দিষ্ট সংবাদ বুলেটিনে প্রযোজকই হন পরিচালক এবং তিনি স্টুডিও ক্রু, রিপোর্টার, আউটডোর ক্রু, ক্যামেরা পারসন, বার্তা সম্পাদক, ভিডিও সম্পাদক প্রত্যেকের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
ইকবাল আহমেদ খোকন