Television Production

ইলেক্ট্রনিক ক্যামেরা কিভাবে কাজ করে  ( সমীর কুশারী )

ইলেক্ট্রনিক ক্যামেরা কিভাবে কাজ করে  ( সমীর কুশারী )

আমরা সব কিছু দেখি আমাদের চোখ দিয়ে। আসলে আমরা চোখ দিয়ে দেখি, মগজ দিয়ে সেটা বুঝি। টেলিভিশন এর ছবি তোলা হয় টিভি ক্যামেরায়, চলন্ত দৃশ্য দেখার যত কৌশল তার সবই ঘটে আমাদের চোখ আর মগজে। টেলিভিশন এর ছবি তোলার আশল কৌশল রয়েছে টিভি ক্যামেরায়।

সাধারণ ক্যামেরার সাথে আমাদের চোখের অনেকখানি মিল আছে। আবার টিভি ক্যামেরার সাথেও মিল আছে চোখের। তবে এই মিল সাধারণ ক্যামেরার চাইতে টিভি ক্যামেরার বেলাতেই বেশি।

আসলে সাধারণ ক্যামেরায় কোন দৃশ্যের ছাপকে শুধু একটা ফিল্মে বা প্লেটে ধরে রাখলেই চলে; কিন্তু টিভি ক্যামেরায় একটি দৃশ্যকে শুধু ধরলে চলবে না, তাকে আবার বেতারে দূরে পাঠাতে হবে। তার ওপর সমস্যা হল ছবির সবকটা অংশকে একসাথে পাঠাবার উপায় নেই। তাই পুরো ছবিটা আগে ভেঙ্গে ফেলতে হবে অসংখ্য ছোট ছোট বিন্দুতে, এমনি প্রত্যেক বিন্দুর জন্যে তৈরী করতে হবে নানা শক্তির আলাদা বিদ্যুৎ- তাড়না; তারপর তাদের পর পর আলাদাভাবে পাঠাতে হবে বেতারে। আর এ সবই ঘটা চাই নিমেষের মধ্যে একবারে বিদ্যুৎবেগে। এমনিভাবে ছবিকে লক্ষ লক্ষ ভাগে ভেঙ্গে ফেলার ব্যবস্থাই হল ছবি স্ক্যান করা বা মাত্রাবিভাগ।

টিভি ক্যামেরায় ছবি স্ক্যান করে তাকে অসংখ্য ছোট ছোট আলোর বিন্দুতে ভেঙ্গে ফেলার জন্যে ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রন কণার প্রবাহ। শুধু ছবি ভেঙ্গে ফেললে বা দূরে পাঠালে হবে না, পাঠানো চাই চলন্ত ছবি। আমাদের চোখের ‘দৃষ্টির রেশ’ বলে একটা গুণ আছে; অর্থাৎ কোন দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি অক্ষিপটের ওপর পড়লে এক সেকেন্ডের দশ-ভাগের এক ভাগ সময় পর্যন্ত তার ছাপ মগজে থাকে। চলন্ত দৃশ্যের অনুভূতি সৃষ্টি করতে হলে প্রতি সেকেন্ডে সেই দৃশ্যের পর পর অন্তত পঁচিশটি ছবি ফেলতে হবে চোখের সামনে, তাহলেই পর পর দুটো ছবির মধ্যে ফাঁক বোঝা যাবে না, পুরো দৃশ্যটা চলন্ত মনে হবে।

সিনেমার ফিল্মে পরপর যেসব স্থির চিত্র ব্যবাহর করা হয় তাদের বলা হয় ‘ফ্রেম’। সিনেমায় সচরাচর ২৪টি ফ্রেম দেখানো হয় প্রতি সেকেন্ডে। আমাদের দেশে এ.সি বিজলি হল ৫০ সাইকলের অর্থাৎ তাতে ইলেকট্রন প্রবাহ দিক পরিবর্তন করে প্রতি সেকেন্ডে পঞ্চাশবার। এমনি বিদ্যুৎ প্রবাহের সাথে তাল রেখে আমাদের দেশে টেলিভিশনে প্রতি সেকেন্ডে পঁচিশটি ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। তাতে গ্রাহক-যন্ত্র তৈরী কিছুটা সহজ হয়, খরচও বাঁচে।

টিভির ক্যামেরা শুধু ক্যামেরা তো নয়, তার ভেতর রয়েছে একটা বায়ূশূন্য ইলেকট্রন টিউব অথবা ধরা যাক একটি দৃশ্যের ছবি তোলা হচ্ছে টিভি স্টুডিওতে। দৃশ্যটির ওপর ফেলা হয়েছে স্টুডিওর কৃত্রিম সিসিডি অথবা সিএমওএস বৈদ্যুতিক আলো। দৃশ্যের নানা অংশ থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়ছে ক্যামারার লেন্সে। এই লেন্সের পেছনেই আছে ক্যামেরা টিউব অথবা সিসিডি অথবা সিএমওএস এর আলোক সংবেদনশীল পর্দা। এই পর্দায় যে ছবি তৈরী হয় তা স্ক্যান করতে শুরু করে ক্যামেরা টিউবের ভিতরে একটি ইলেকট্রন রশ্মি-অর্থাৎ বিদ্যুৎ কনিকার অতি সুক্ষ্ম একটি প্রবাহ।

আমরা যখনই বই পড়ি তখন অক্ষরগুলো দেখি এক লাইন করে। চোখের দৃষ্টি যেতে থাকে বাঁ থেকে ডানে, তারপর আবার সাঁ করে নেমে যায় বাঁ দিকে পরের লাইনে। এমনি করে একটি পৃষ্ঠার সবগুলো লাইন শেষ হয়ে গেলে আবার ঝট করে দৃষ্টি চলে যায় পরের পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে। টিভির প্রতিটি ফ্রেম স্ক্যান করার ব্যাপারটাও অনেকটা তেমনি।

টিভি ক্যামেরায় ইলেকট্রন রশ্মি দিয়ে ছবি স্ক্যান করার ব্যবস্থা। উপরের সারিতে বাঁ থেকে ডাইনে তীরচিহ্ন দেয়া রেখায় ছবি স্ক্যান হতে থাকে;
তারপর ছবির নীচে ডান কোনায় পোঁছে ইলেকট্রন রশ্মি ঝট্ করে ছুটে যায় ওপরের সারিতে বাঁ দিকের কোণায়।

একটি বই-এর পৃষ্টায় থাকে বিশ, ত্রিশ কিংবা বড়জোর চল্লিশ লাইন। টিভির পর্দার ছতিতে থাকে কত লাইন? সে হিসেব আবার নানা দেশে নানা রকম। আমাদের দেশে আর পশ্চিম ইউরোপে ব্যবহার করা হয় ৬২৫লাইন। ছবিতে লাইনের সংখ্যা যত বেশি হয়, সে ছবিতে সুক্ষ্ম আলো-আঁধারী তত ষ্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে; অবশ্য বেশি লাইনের ছবি তৈরীতে খরচও বেশি পড়ে।

টেলিভিশনের প্রতি ফ্রেম এমনিতেই দৃষ্টি-রেশের সময়ের চেয়ে অনেক কম সময় ধরে দেখানো হয়। তার ওপর প্রথমে ১,৩,৫ এমনি বেজোর সংখ্যার লাইনগুলো একবার স্ক্যান করা হয়, তাতে সময় লাগে এক সেকেন্ডের পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ; তারপর জোড় সংখ্যার লাইনগুলো একই ভাবে স্ক্যান করা হয়- তাতেও লাগে একই সময়। এভাবে পুরো ফ্রেমটা স্ক্যান হয়ে যায় ১/২৫ সেকেন্ড সময়ে। এভাবে স্ক্যান বা মাত্রাবিভাগ করার ফলে চলন্ত ছবির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সুবিধে হয়।

টিভি ক্যামেরার ইলেকট্রন রশ্মি দৃশ্যের প্রতিচ্ছবিকে স্ক্যান করে তাকে ভেঙ্গে ফেলে অসংখ্য উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল আলোর বিন্দুতে; তারপর এই আলোর বিন্দুগুলো থেকে তৈরী হয় লক্ষ লক্ষ কম-বেশি বিদ্যুৎ-তাড়না। ব্যাপারটা কেমন করে ঘটে তা ক্যামেরার ভেতরকার একটি ছবি দেখলে বুঝতে সুবিধে হবে। Professional use এর জন্য টেলিভিশনের নানা ধরনের ক্যামেরা তৈরী হয়েছে। তার মধ্যে একটি ধরনের নাম হল ‘ইমেজ অরথিকন’ সংক্ষেপে বলা হয় আই.ও ক্যামেরা। সাধারণ ক্যামেরার মতোই এর লেন্সের ভেতর দিয়ে সামনের দৃশ্যের উলটো প্রতিবিম্ব পড়ে একটি পর্দার ওপর। সাধারণ ক্যামেরায় প্রতিবিম্ব পড়ে রাসায়নিক মশলা মাখানো প্লেট বা ফিল্মের ওপর। কিন্তু টিভি ক্যামেরায় যে পর্দায় প্রতিবিম্ব পড়ে সে হল ক্যামেরা টিউবের সামনের প্রান্ত।

ইমেজ অরথিকন (ও.ঙ) টেলিভিশন ক্যামেরার ভেতর দৃশ্যের প্রতিচ্ছবিকে ভেঙ্গে বিদ্যুং তাড়ানায় করার কৌশল।

এই পর্দা হল আসলে একটি অর্ধস্বচ্ছ পাতলা কাঁচ বা অভ্রের তৈরি আলোক সংবেদী ক্যাথোড। এর ভেতরের পিঠে রুপো আর সিজিয়াম ধাতুর তৈরি মশলা মাখানো। কাচটা খুব পাতলা বলে এর সামনে যে দৃশ্যের প্রতিবিম্ব পড়ে তার পেছন দিকেও ফুটে ওঠে হুবহু সেই ছবি। এই পর্দার ওপরকার ছবিকে স্ক্যান করতে থাকে ক্যামেরা টিউবের অন্য পাশ থেকে ইলেকট্রন রশ্নি এসে। আর তার ফলে পর্দা থেকে ছিটকে বেরোয় ইলেকট্রন কণিকা। পর্দার ঠিক পেছনে বসানো অতি সূক্ষ একটি ধনাত্নক জাল এসে ইলেকট্রন টেনে নেয়। পর্দার যে জায়গায় বেশি আলো পড়েছে সেখানে ইলেকট্রন আটকা পড়ে বেশি। যেখানে তেমন আলো পড়েনি সেখানে ইলেকট্রন ধরা পড়ে কম। অর্থাৎ এভাবে ছবির আলোর আঁধারী অনুযায়ী বিদ্যুৎ প্রবাহের মডুলায়ন ঘটে। আরেকভাবে বললে বলা যায় ইলেকট্রন রশ্মি যখন দৃশ্যের কোন উজ্জ্বল অংশ স্ক্যান করে তখন বিদ্যুৎ তাড়না হয় জোরালো, অন্ধকার কোন অংশ স্ক্যান করলে বিদ্যুৎ তাড়না হয় দুর্বল। কম বেশি নানা তীব্রতার এমনি বিদ্যুৎ তাড়না তৈরি হয় আশ্চার্য রকম দ্রুত গতিতে প্রতি সেকেন্ডে বহু লক্ষবার। তারপর এসব বিদ্যুৎ তাড়না চাপিয়ে দেয়া হয় টিভির বাহক তরঙ্গের ওপর। আমাদের ঘরে যে বিজলির প্রবাহ বয় তাতে ইলেকট্রন দিক পরিবর্তন করে প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার। অথচ বাংলাদেশের সকল টেলিভিশনে যে বাহক তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় তার স্পন্দন হল সেকেন্ডে প্রায় ২০০ মেগাহার্ডস (অথাৎ ২০ কোটি বার)। বিদ্যুৎ স্পন্দনের বেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার বা ত্রিশ কোটি মিটার, কাজেই আমাদের টেলিভিশনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হল মাত্র দেড় মিটারের মতো। অথচ বেতারে শর্ট-ওয়েভ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় সচরাচর মোটামুটি ১৯,২৫,৩১ বা ৪১ মিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। এমনি দ্রুত স্পন্দন সৃষ্টি কেবল ইলেকট্েরনর মতো অতি হালকা বিদ্যুত কণিকা দিয়েই সম্ভব।

ধরা যাক যে কোন একটি দৃশ্যের ছবি না হয় পড়ল ক্যামেরা টিউবের পর্দায়, আলোর তীব্রতা অনুযায়ী সে ছবিকে ভেঙ্গে ফেলা হল অসংখ্যা ছোট ছোট আলোক বিন্দুতে, তারপর প্রতিটি আলোক-বিন্দুর উজ্জ্বলতা অনুযায়ী তৈরী হল বিদ্যুৎ তাড়না। এসব বিদ্যুৎ-তাড়নাকে বেতারের ঢেউএ চাপিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে চারপাশে। তার পর আবার তাদের টিভি সেটে বন্দী করে হুবহু মূল দুশ্যের ছবি তৈরী করতে হবে। টিভি ক্যামেরার ইলেকট্রন রশ্মি পুরো একটি দৃশ্যের ওপর চোখ বোলায় সেকেন্ডে ২৫ বার। প্রতিটি দৃশ্যে রয়েছে ৬২৫ লাইন, ধরা যাক প্রত্যেক লাইনে রয়েছে ৬২৫টি বিন্দ্। তাহলে প্রতিটি ফ্রেমে আছে চার লাখ বিন্দু, আর প্রতি সেকেন্ডে এমনি বিন্দু স্ক্যান করা হচ্ছে প্রায় এক কোটি বিন্দু। এই ভাবেই টিভি ক্যামেরায় ছবি তৈরী হয়।

What's your reaction?

Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0

You may also like

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Television Production

What is Pre-production ?

What is Pre-production? মানুষ তার কাল্পনিক চিন্তাভাবনাকে ক্যামেরায় ধারণ করে তার একটি বাস্তবরুপদানের প্রয়াস চালায় ...